টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় এমপি রানা ছাড়াও তাঁর তিন ভাইসহ পলাতক ১০ আসামির বিরুদ্ধে এই পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আমিনুল ইসলাম ওই হত্যা মামলার চার্জশিট গ্রহণ শেষে তাঁদের বিরুদ্ধে এই পরোয়ানা জারি করেন। গতকাল ফারুক হত্যা মামলায় চার্জশিটের ওপর শুনানির দিন ধার্য ছিল। আরো যাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাঁরা হলেন এমপি রানার তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা, এমপি রানার ঘনিষ্ঠ সহযোগী কবির হোসেন, দারোয়ান বাবু ওরফে দাঁতভাঙা বাবু, তৎকালীন যুবলীগ নেতা আলমগীর হোসেন চাঁন, নাসির উদ্দিন নূরু, ছানোয়ার হোসেন ছানু ও সাবেক পৌর কমিশনার মাসুদুর রহমান মাসুদ।
মামলার অন্য আসামি আনিসুর রহমান রাজা, মোহাম্মদ আলী, ফরিদ আহমেদ ও সমীর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আনিসুর রহমান রাজা ও মোহাম্মদ আলী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই জবানবন্দিতে ফারুক হত্যার ঘটনায় এমপি রানা ও তাঁর তিন ভাইয়ের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁর কলেজপাড়া এলাকার বাসার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার তিন দিন পর ফারুকের স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে টাঙ্গাইল মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
প্রথমে মামলাটি টাঙ্গাইল মডেল থানার পুলিশ তদন্ত করলেও পরবর্তী সময়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওপর তদন্তভার দেওয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টাঙ্গাইলের গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর গোলাম মাহফীজুর রহমান ও কোর্ট ইন্সপেক্টর আনোয়ার হোসেন জানান, চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ফারুক হত্যা মামলায় আদালতে মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। গতকাল মামলার বাদী নাহার আহমেদের উপস্থিতিতে আদালত শুনানি শেষে চার্জশিট গ্রহণ করেন এবং এমপি রানা ও তাঁর তিন ভাইসহ পলাতক দশ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গোলাম মাহফীজুর রহমান আরো জানান, আসামি এমপি আমানুর রহমান খান রানা ও তাঁর ভাই সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি দেশেই আত্মগোপন করে আছেন। রানার অন্য দুই ভাই জাহিদুর রহমান খান কাকন ও সানিয়াত খান বাপ্পা দেশের বাইরে রয়েছেন।
অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। টাঙ্গাইল মডেল থানা পুলিশ সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানাসহ পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মাহফীজুর রহমান জানান। টাঙ্গাইল মডেল থানার ওসি নাজমুল হক ভূঁইয়া গত রাতে বিডিনিউজ কে বলেন, ফারুক হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে এমনিতেই অভিযান অব্যাহত আছে। আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কাগজপত্র পাওয়ার পর অভিযান আরো জোরদার করা হবে। তাদের গ্রেপ্তার করা হলে আদালতে হাজির করা হবে। ফারুক হত্যা মামলায় গতকাল আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ এবং পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় সন্তোষ প্রকাশ করে আদালত এলাকায় মিছিল-সমাবেশ করেছে বাদীপক্ষ। মিছিলে নেতৃত্ব দেন নিহত ফারুক আহমেদের স্ত্রী টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাহার আহমেদ। মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে নাহার আহমেদ ছাড়াও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া বড় মনি ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সোলায়মান হাসান।
বক্তারা মামলাটি দ্রুতবিচার আদালতে স্থানান্তর করে দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে দোষীদের ফাঁসির দাবি জানান। গতকাল সন্ধ্যায়ও ঘাটাইলে মিছিল-সমাবেশ করেছে রানাবিরোধী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের বলেন, ‘ফারুক হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের পাশাপাশি টাঙ্গাইলবাসীও খুশি। এখন আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি আমাদের।’ আদালতে দাখিল করা চার্জশিট থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার বিপুল সম্ভাবনাও ছিল তাঁর। অন্যদিকে পৌরসভার তৎকালীন মেয়র এমপি রানার ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তিও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। হত্যাকাণ্ডের দেড় মাস আগে এমপি রানা ও তাঁর তিন ভাই এবং নাছির উদ্দিন, ছানোয়ার হোসেন ও আলমগীর হোসেন ফারুককে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমানুর রহমান খান রানার কলেজপাড়ার বাসার কাছে গ্লোবাল ট্রেনিং সেন্টারে আনিসুর রহমান রাজার মাধ্যমে ফারুককে ডেকে আনা হয়। সেখানে ফারুককে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থিতা থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন এমপি রানার ভাই বাপ্পা। কিন্তু ফারুক এতে রাজি হননি। একপর্যায়ে ফারুক কক্ষ থেকে বের হয়ে বাথরুমে যান।
বাথরুম থেকে বের হয়ে ফেরার পথে ফারুককে এমপি রানার ঘনিষ্ঠ কবির হোসেন পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। পরে এমপি রানা দুই মিনিটের মধ্যে সব পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন। তাঁর কথামতো রাজা, মোহাম্মদ আলী, আবদুল হক, সমীর ও কবীর হোসেন ফারুকের মৃতদেহ তাঁর কলেজপাড়া বাসার সামনে ফেলে রেখে আসেন। সেখান থেকেই তাঁর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। আনিসুর রহমান রাজা ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে তিন দফায় মোট ১৫ দিন রিমান্ড শেষে ওই বছরের ২৭ আগস্ট টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহাদত হোসেনের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আরেক আসামি মোহাম্মদ আলী গ্রেপ্তার হন একই বছরের ২৪ আগস্ট। তিনি ১০ দিনের রিমান্ড শেষে ৫ সেপ্টেম্বর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শেখ নাজমুন নাহারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। উভয় আসামির জবানবন্দিতে ফারুক আহমেদ হত্যাকাণ্ডে ঘাটাইলের এমপি আমানুর রহমান খান রানা ও তাঁর ছোট ভাই সানিয়াত খান বাপ্পার জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। আর এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে এমপি রানার অন্য ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি ও জাহিদুর রহমান খান কাকন যুক্ত বলে আসামি মোহাম্মদ আলী তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার হওয়া তৎকালীন পৌর কাউন্সিলর শফিকুল হক শামীম এবং ফিরোজ আহমেদ ও মোহাম্মদ ফজলুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগপত্রে এই মামলা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া এই মামলায় অভিযুক্ত আবদুল হক খুন হওয়ায় তাঁকেও এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। আবদুল হক ২০১৪ সালের ১০ আগস্ট প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। মামলায় মোট ৩৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। আমানুর রহমান খান রানা টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি ছিলেন টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
ফারুক হত্যায় তাঁদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর থেকে দলের মধ্যে দাবি ওঠে তাঁদের বহিষ্কারের। ‘নির্যাতিত আওয়ামী পরিবারের’ ব্যানারে এমপি রানাসহ তাঁর ভাইদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১৮ অক্টোবর টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়। সেখানে খান পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি। গত মাসের শেষ দিকে দলের কেন্দ্র থেকে নতুন কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই কমিটিতে খান পরিবারের চার ভাইয়ের কেউ নেই, তবে তাঁদের বাবা আতাউর রহমান খান সদস্য হিসেবে রয়েছেন। টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগেরও নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন সহিদুর রহমান খান মুক্তি। টাঙ্গাইল-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. মতিউর রহমান মারা যাওয়ার পর ২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর উপনির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হন আমানুর রহমান খান। তখন আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী সময় তাঁকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। এমপি রানার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ব্যাপারে ২০১২ সালের উপনির্বাচনের সময় তাঁর পক্ষে কাজ করার জন্য গঠিত নাগরিক কমিটির সভাপতি জুলফিকার হায়দার বিডিনিউজ কে বলেন, তিনি (এমপি রানা) সরকার দলের এমপি। কিন্তু কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে তিনি দোষী না নির্দোষ। তবে দেড় বছর ধরে এমপি এলাকায় নেই। ফলে উন্নয়ন থেকে ঘাটাইলবাসী বঞ্চিত। এ ব্যাপারটি সরকার বিবেচনা করলে ঘাটাইলবাসীর জন্য মঙ্গল হবে।