আইপিএলের নবম আসরের আলো ঝলমলে উদ্বোধন হয়ে গেল কাল। নাচে-গানে, বাজনা-বাদ্যিতে, ঝলকে-চমকে। সব মিলিয়ে যেন আগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানগুলোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস সেখানে। সাকিব আল হাসান ও মুস্তাফিজুর রহমানও কি পারবেন আইপিএলে বাংলাদেশের পতাকা আগের আসরগুলোর চেয়ে আরো ওপরে ওড়াতে? আইপিএলে থাকতে পারতেন আরো অনেকে—অন্তত বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্দরমহলের বিশ্বাস তেমন। কিন্তু তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, মুশফিকুর রহিমদের টানেনি প্রতিযোগিতার কোনো দল। উপেক্ষা করার উপায় নেই অবশ্য সাকিবকে। আইপিএলে অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছেন তিনি। এবার সঙ্গে যোগ হয়েছেন নতুন সেনসেশন মুস্তাফিজ। এই যুগলবন্দিতে আগের যেকোনো আইপিএলে চেয়ে বাংলাদেশিদের পারফরম্যান্স ভালো হবে বলে আশাবাদীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আইপিএলে বাংলাদেশিদের পারফরম্যান্সে এমনিতে অবশ্য জ্বলজ্বলে ব্যতিক্রম একমাত্র সাকিব। বাকি কেউই পারেননি সুনামের সুবিচার করতে।
২০০৮ সালের প্রথম আসরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সুযোগ পান আবদুর রাজ্জাক। এই বাঁহাতি স্পিনারকে ৫০ হাজার ডলার দিয়ে কেনে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। কিন্তু সেবার একটি মাত্র ম্যাচ খেলেন রাজ্জাক। দুই ওভারে ২৯ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থেকেই শেষ তাঁর আইপিএল অভিযান। কী আশ্চর্য, ২০০৯ সালের পরের আসরে সুযোগ পাওয়া মাশরাফি বিন মর্তুজা ও মোহাম্মদ আশরাফুলেরও একই দশা! একাদশে নামেন একটি করে ম্যাচে। ৭৫ হাজার ডলারে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে নাম লেখানো আশরাফুল নিজের একমাত্র ইনিংসে ১০ বলে করেন ২ রান। আর মাশরাফি ৪ ওভারে দেন ৫৮ রান। শেষ ওভারে ডেকান চার্জার্সের ২১ রান প্রয়োজন, এমন অবস্থায় বোলিংয়ে এসেও কলকাতা নাইট রাইডার্সকে জেতাতে পারেননি ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। অথচ মাশরাফিকে কত আগ্রহ করেই না দলে নিয়েছিল কেকেআর! ৫০ হাজার ডলারের ভিত্তিমূল্যের ১২ গুণ বেশিতে, ৬ লাখ ডলারে।
কেকেআরের প্রতিনিধি জুহি চাওলা ও কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের প্রতিনিধি প্রীতি জিনতা—মাশরাফির জন্য এই দুই বলিউড নায়িকার দড়ি টানাটানি ছিল সেবারের নিলামের সবচেয়ে বড় ঘটনা। ৮৩টি বিডের রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তার পর অবশেষে সাফল্যের হাসি জুহির। কিন্তু তাঁর দলের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন কই বাংলাদেশের পেসার! তামিম ইকবালের ক্ষেত্রে আবার সে কথা বলা যাবে না সেভাবে। ২০১২ সালে পুনে ওয়ারিয়র্স তাঁকে কেনে ৫০ হাজার ডলারে। শুরুর নিলামে অবিক্রীত থাকলেও পরে এই ওপেনারকে ভিড়িয়ে বিদেশি খেলোয়াড়ের কোটা পূরণ করে দলটি। কিন্তু একটি ম্যাচেও তো খেলায়নি! অনুশীলন আর দলের সঙ্গে ঘোরাঘুরিতে শেষ তাই তামিমের স্বপ্নের আইপিএল-মিশন। মিটিমিটি এসব তারকার ভিড়ে আইপিএলে আপন আলোয় উজ্জ্বল কেবল সাকিব। ২০১১ সালে কেকেআর তাঁকে কেনে ৪ লাখ ২৫ হাজার ডলারে। সেবার সাত ম্যাচে মোটে ২৯ রান করলেও বোলিংয়ে নেন ১১ উইকেট। ১৫.৯০ গড়ে এবং ৬.৮৬ ইকোনমি মন্দ কী! কেকেআরও ওঠে শেষ চারে। আর পরেরবার তো চ্যাম্পিয়নই! সেখানে দারুণ ভূমিকা সাকিবের। আট ম্যাচে ব্যাটে মোটে ৯১ রান করলেও বোলিংয়ে ১৬.২৫ গড়ে ১২ শিকার।
ফাইনালেও ছিল তাঁর দাপুটে উপস্থিতি। বোলিংয়ে তিন ওভারে ২৫ রানে নেন ১ উইকেট। পরে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নেমে ৭ বলে ১১ রানে অপরাজিত থেকে দলকে শিরোপা জিতিয়ে তবে মাঠ ছাড়েন। এর মধ্যে ১৯তম ওভারের শেষ বলে বাউন্ডারি মেরে কেকেআরের জয়ের বাতিঘরটা দূর থেকে নিয়ে আসেন কাছে। ৭ বলে ১৩ রানের কঠিন প্রয়োজনীয়তা এরপরই তো নেমে আসে ৬ বলে ৯ রানে! ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিম্বাবুয়ে সফরের কারণে সাকিবকে আইপিএল খেলার অনুমতি দেয়নি বিসিবি। কেকেআরও উঠতে পারে না শেষ চারে। ২০১৪ সালে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের সঙ্গে দরকষাকষির পর দুই কোটি ৮০ লাখ রুপিতে পুরনো যোদ্ধাকে নতুন করে দলে ভেড়ায় কলকাতার ফ্র্যাঞ্চাইজি। ফল পেতেও দেরি হয় না। আবার চ্যাম্পিয়ন কেকেআর! সেবার প্রথমবারের মতো আইপিএলে হেসে ওঠে সাকিবের ব্যাট। ১৩ ম্যাচে ২২৭ রান করেন ৩২.৪২ গড়ে। বোলিংয়ে ১১ শিকার গড়পড়তা মনে হতে পারে। কিন্তু ইকোনমি যখন জানবেন ৬.৬৮, সাকিবের বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানদের হাঁসফাঁস অনুমান করা যায় সহজেই।
সর্বশেষ আসরেও সাকিবকে তাই ছাড়ে না কেকেআর। কিন্তু বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজের কারণে আইপিএলে চার ম্যাচের বেশি খেলতে পারেন না এই অলরাউন্ডার। তাতে ৩৬ রানের পাশাপাশি ৪ উইকেট। কেকেআরও তাই থাকে না শিরোপা দৌড়ে। পরীক্ষিত পারফরমার সাকিবকে এবারও তাই নিলামে উঠতে দেয় না শাহরুখ খানের দল। শুরু থেকে তাঁকে পাওয়ায় কেকেআরের স্বপ্নের আকাশটাও এবার অনেক বড়। ঠিক যেমনটা সানরাইজার্স হায়দরাবাদের। ‘কাটার মাস্টার’ মুস্তাফিজকে নিলাম-যুদ্ধে জিতে নেয় এক কোটি ৪০ লাখ রুপিতে। দলের কোচ টম মুডি ভীষণ উচ্ছ্বসিত এই বাঁহাতি পেসারকে নিয়ে, ‘দারুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটার মুস্তাফিজ। বড় ম্যাচে যে কত সহজভাবে নেয়, এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে সেটি দেখেছি। ওর ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।’ মুস্তাফিজের সামর্থ্যে পূর্ণ আস্থা সানরাইজার্স হায়দরাবাদের। আর সাকিব তো কলকাতা নাইট রাইডার্সের পরীক্ষিত বিজয়ী যোদ্ধাই। অন্য বাংলাদেশিদের আইপিএল ইতিহাস বিবর্ণ হলে কী হবে; এবারের দুজন মিলে আইপিএল ক্যানভাস রাঙিয়ে দিতে পারবেন—এই আশাতেই তো শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের আইপিএল!