চলে গেলেন কলকাতার প্রথম ‘রাতপরি’ মিস শেফালি। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কিডনির সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছিল তাঁর। শেষের দিকে প্রাই নাকি বলতেন, আর বেশি সময় নেই হাতে। এবার তিনি ছুটি নেবেন। হাসপাতাল থেকে সোদপুরে নিজের বাড়িতে ফেরার পরেও বেশ সুস্থই ছিলেন। আচমকাই বৃহস্পতিবার ভোরে ঝরে গেলেন চিরকালের মত।
শরীরটা তাঁর বেশ কিছুদিন ধরেই খারাপ। গত সপ্তাহেই ছাড়া পেয়েছিলেন হাসপাতাল থেকে। অনেকদিন পর ২৭ জানুয়ারি তিনি বাড়ির বাইরে পা রেখেছিলেন। এসেছিলেন সেই গ্র্যান্ডেই। উপলক্ষ্যে একটি বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান। কলকাতার ক্যাবারে বাঙালি, যৌনতা এবং মিস শেফালি শীর্ষক একটি বই লিখেছেন ঐশিকা চক্রবর্তী।
২০১৫ থেকে ২০১৯- শেফালির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ কথোপকথন ধরা রয়েছে সেই বইতে। নারায়ণগঞ্জের আরতি দাস কীভাবে ক্যাবারেকে বসালেন তাঁর শরীরে, কীভাবে তাঁকে নিয়ে সমাজ রগরগে গল্প ফেঁদেছে, তাঁর নাচকে খেমটা নাচের আখ্যা দিয়েছে সেই সব প্রশ্নই তুলে ধরেছেন ঐশিকা। গ্র্যান্ডের সেই বিখ্যাত মুঘল রুমেই হল বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। সেদিন আবার স্বমহিমায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন শেফালী।
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। বারবার ইনহেলার নিচ্ছিলেন। বললেন তাঁর সময়কার পার্ক স্ট্রিটের কথা। তবে এখনও যে তাঁকে নিয়ে নিয়মিত লেখা হয় তা শুনে তিনি অবাক। বৃহস্পতিবার ভোরে আচমকাই চলে গেলেন তিনি। এককালে যাঁরা তাঁর খুব কাছের ছিলেন তাঁরাও বেশ পরে খবর পেলেন। বারবার
হাসপাতালে ভরতি, চিকিৎসার জন্য একসময় অর্থসংকটে পড়তে হয় তাঁকে। সে সময়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। এছাড়াও শেফালি চাইতেন তাঁর বায়োপিক হলে যেন ঋতুপর্ণাই অভিনয় করেন। মিস শেফালি নন, ঋতুর কাছে তিনি শেফালি দি। তাই তাঁর চলে যাওয়ার খবরে খুবই মন খারাপ ঋতুপর্ণার। শেফালি দির উদ্দেশ্যে তিনি লিখলেন, ‘সৌন্দর্য এবং চারুতার অন্যতম প্রতীক মিস শেফালি। ক্যাবারে নৃত্যে তাঁর অবদান অপরিসীম। বাংলা এবং শিল্পজগৎ তাঁকে খুব মিস করবে’।
তবে মিস শেফালি যাতে তাঁর ক্যাবারের মধ্যেই মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকেন তার চেষ্টা করবেন তিনি, এমনটাই তাঁর ইচ্ছে। সেই সঙ্গে মিস শেফালির জীবন সংগ্রাম, অভিনয় এবং কেনই বা তিনি ক্যাবারে ক্যুইন হিসেবে পরিচিত সেই বিশেষ দিকটিও তুলে ধরতে চান।
কলকাতা এবং ছা-পোষা বাঙালি তখনও ক্যাবারে কালচারের সঙ্গে পরিচিত নয়। সমাজ আরও রক্ষণশীল। সেই সময় সাতের দশকে নিতান্ত পেটের দায়ে তিলোত্তমায় বিপ্লবের মতো আছড়ে পড়েছিলেন আরতি দাস। তিনিই হোটেল ফিরপো-র ক্যাবারে ক্যুইন মিস শেফালি। পরে পার্ক স্ট্রিট, গ্র্যান্ড হোটেল বুঁদ হয়েছিল তাঁর নাচের নেশায়। কালের নিয়ম মেনে একটা সময় ভাটার টান আসে তাঁর জনপ্রিয়তাতেও। শেষের দিকে অর্থাভাবে ঠিক মতো চিকিৎসাও হচ্ছিল না তাঁর।
সমাজ তাঁকে প্রান্তবাসী করলেও বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যিজিৎ রায় তাঁকে সাদরে ডেকে নিয়েছিলেন তাঁর দু’টি ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’তে। ‘বহ্নিশিখা’ (১৯৭৬), ‘পেন্নাম কলকাতা’ (১৯৯২)-র মতো ছবিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে।